সময় চিনি দেয়াল লেখায়
সম্বিত বসু
[১৯৮৫, মাধ্যমিক]
১৯৭৫ সাল। দেয়ালে লেখা কমরেড চারু মজুমদারের নাম ফিকে হয়ে এসেছে। তার ওপর চুনের পোঁচ পড়েছে। সেখানে এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধীর ছবি আঁকা হবে। আর কিছুদিনের মধ্যেই জরুরি অবস্থা জারি হতে চলেছে।
বাঙুর-লেকটাউন তখনও মফস্বল। শীতের ভোরে মোটা কুয়াশার আস্তরণ থাকে হাওয়ায়। নকশাল আমল থেকে কলকাতা রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়তে শিখেছে। আমাদের মফস্বল নিঝুম হয়ে পড়ে তার অনেক আগেই। বিবিধ ভারতীতে মনের-মতন-গান শেষ হলে বাড়িতে বাড়িতে হারমোনিয়াম বেরিয়ে পড়ত অব্যর্থভাবে। সোজা সা-রে-গা-মা থেকে ইমনের গত হয়ে "এই তো তোমার আলোকধেনু"। সন্ধ্যের নিঝুম বাড়িয়ে ল্যাম্পপোস্টের মাঝে অন্ধকারের পুকুর। নিস্তব্ধতা কাটতো মুঘল-সাম্রাজ্যের-পতন-এর সঙ্গে দিল্লি থেকে খবর-পড়ছি-নিলিমা-সেন-এর প্রতিযোগিতায়। রাতে শেয়ালের ডাক শোনা যায়।
লেকটাউন তখনও শহরতলী, প্রায় মফস্বল। খুব খোলামেলা। লিঙ্ক রোড - যা নাকি ভিআইপি রোড আর যশোর রোডকে জোড়ে - চওড়া পরিস্কার রাস্তা। ভিআইপি রোড আর লিঙ্ক রোড যেখানে ক্রস করেছে সেখানে লম্বা টাওয়ারে লাল রঙের আলোয় লেখা থাকে - ইএমসি। অনেক দূর থেকে দেখা যায়। ভিআইপি রোডে অক্লেশে গাড়ি ষাট-সত্তর কিলোমিটারে সাঁই-সাঁই করে চলতে পারে। উল্টোডাঙার ঘুমন্ত মোড় ছাড়ার পরে দুপাশে অন্ধকার। একদিকে কেষ্টপুর খাল। শীতকালে সেই খাল দিয়ে খড় বোঝাই নৌকো যায়। সেখানে নৌকোর মাঝি গুণ টানে। ভিআইপি রোডের অন্য দিকেও কিছু নেই। শুধু উল্টোডাঙা আর লেকটাউনের মাঝে ইস্টার্ন পেপার মিলের কারখানা। ইস্টার্ন পেপার মিলের মালিক অধীর বোস। লেকটাউনে থাকেন। শোনা যায় লেকটাউনের সবথেকে ধনী লোক। জয়া সিনেমার প্রায় উল্টোদিকে তার তিনতলা বাড়ি। সঙ্গে সবুজ বড় লন। বাড়ির সামনে বিদেশী গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে মিষ্টি কিনতে যাবার সময় বা হাঁড়ি-কলসির দোকানে খাতা কিনতে যেতে গিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখি। পাশাপাশি দুটো মিষ্টির দোকান। অন্নপূর্ণা আর নিউ অন্নপূর্ণা। দুই ভাই। শোনা যায় ভায়ে-ভায়ে ঝগড়া হয়ে ব্যবসা আলাদা হয়ে যায়। সেখানে মিষ্টি কিনলে টাকা-প্রতি একটা করে স্ট্যাম্প দেয়। রেমন বোনাস স্ট্যাম্প। আমরা বাড়িতে এসে সেই স্ট্যাম্প, স্ট্যাম্পের জন্য দেওয়া খাতায় সেঁটে রাখি। কেন, জানিনা। অনেক স্ট্যাম্প জমলে নাকি কী পাওয়া যাবে! কেউ কোনোদিন কিছু পেয়েছে বলে শুনিনি।
লেকটাউনে তখন অনেক পুকুর। তিনটে উল্লেখযোগ্য বড় পুকুরের নাম - এক নম্বর লেক, দু নম্বর লেক আর তিন নম্বর লেক। নামের বাহার না থাক, লেকটাউনের বাহার ছিল যথেষ্ট, যদিও খোলা ড্রেন। দুটো ব্লক। এ ব্লক আর বি ব্লক। এ ব্লক পাতিপুকুরের দিকে। বি ব্লক বাঙুরের দিকে। সেকেন্ড লেক প্রায় মধ্যিখানে। জয়া সিনেমার উল্টোদিকে। তার পাশেই অধিবাসীবৃন্দের পুজো হয়। কালীপুজো করে মিলন সঙ্ঘ। তাদের কোনো মাঠ নেই। পরে দু নম্বর লেকের আধখানা বুজিয়ে মাঠ হল মিলন সঙ্ঘের। পিন্টু চৌধুরী নাকি ফুটবল শেখাতে আসেন। স্কুল বলতে পাতিপুকুরের দিকে আদ্যনাথ - ছেলেদের স্কুল। লেকটাউন গার্লস - মেয়েদের স্কুল। আর পাশে বাঙুরে আমাদের স্কুল।
বাঙুর স্কুল তখন উঠতি ভালো স্কুল। লেকটাউন গার্লস আর বাঙুর বয়েজ - দুটোই গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড। বাঙুর স্কুলের জনার্দনবাবু একাধারে কড়া, অসম্ভব শৃঙ্খলাপরায়ন অথচ অত্যন্ত কোমল মনের হেডমাস্টার। আমি স্কুলে ভর্তি হবো। টাকি না বাঙুর - সেই নিয়ে বাড়ির সবাই দোলাচলে। দূরত্বের জন্য টাকি হেরে গেল। বাঙুরই ঠিক হলো।
বাঙুর তখন লেকটাউনের থেকেও মফস্বল। লেকটাউনের রাস্তা শেষ হয়ে বাঙুরের রাস্তা শুরু হয়, ঠিক সেখানে লেকটাউনের দিকের শেষ বাড়িটা অত্যন্ত আধুনিক দেখতে। সেটা নাকি তুষারকান্তি ঘোষ-এর বাড়ি। 'যুগান্তর'-এর সম্পাদক। লেকটাউনে তাও রাস্তা পাকা। বাঙুরে তখনও পাকা রাস্তা নেই। বর্ষায় নয়নজুলি উঠে আসে রাস্তায়। আমরা স্কুলে যাবার সময়ে খুব সন্তর্পণে বাঁচিয়ে চলি। সেই কাদাই শীতে শুকিয়ে পায়ে পায়ে গুঁড়ো হয়ে রাস্তা হয়ে যায় ধুলোময়। তখনও অনেক ফাঁকা জমি। বাড়ি হবে, এখন আগাছায় ভরা। কোথাও আগাছা কেটে ব্যাডমিন্টন কোর্ট হয়েছে, কোথাও ক্রিকেটের বেসরকারি পিচ।
মা বা বাবার হাত ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ি স্কুলে। কেউ আসে রিকসায়। কেউ বাসে। বাগুইআটি থেকে, দমদম পার্ক থেকে, নাগের বাজার থেকে। স্কুলের চারদিকে পাঁচিল। পাঁচিলের পেছনে আদিগন্ত মাঠ। কেউ বলে সে মাঠ নাকি সোজা সুন্দরবন চলে গেছে। স্পোর্টস হবে ওই মাঠে। পাঁচিলের ভেতরেও মাঠ আছে। একটা মাঠ ঘেঁসের। সবাই বলতো, আমিও বলতাম। ঘেঁষ-এর মানে জানতাম না। এখন অভিধানে দেখলাম লেখা, "কয়লার ছাই; কয়লার গুঁড়ো"। সে মাঠে খেললে সর্বাঙ্গ কয়লার গুঁড়োয় কালো হয়ে যেত। মা-র কাছে অবশ্যম্ভাবী বকুনি। কিন্তু উপায় নেই। কারণ স্কুলের বাকি মাঠগুলো এত নিচু যে বর্ষাকালে সেখানে পায়ের ডিম অবধি জল জমে থাকে। ঘাস বেড়ে যায় হাঁটু সমান। সকালে স্কুলে এসে দেখি শামুক উঠে এসেছে সিমেন্টের রাস্তায়। টিফিনে অন্যমনস্ক হলেই কেউ-না-কেউ রামধাক্কা দেবে। তাতে জুতো-মোজা সপসপে ভিজবেই। আর সেই ভিজে জুতো-মোজা পরে বাকি ক্লাস।
স্কুলে আসি সতীশদার রিকশায়। শ্রীভূমি থেকে ওঠে মণিময় আর ছন্দময়। একদিন খুব ভয় দেখাল। আজ আবার যদি হারিস তাহলে কাল আর তোকে রিকশায় উঠতে দেবো না। আকবরের ষোল সেকেন্ডের সেট-পিসের গোলে পরের দিন রিকশায় ওঠার অধিকার পাওয়া গেল। সেদিন স্কুলে গিয়ে দেখি শিবাজী রাতারাতি ইস্টবেঙ্গল থেকে মোহনবাগান হয়ে গেছে।
আমরা মর্নিং সেকশনে পড়তেই জনার্দনবাবু মারা গেলেন। তাঁকে একবারই দেখেছি - ভর্তির সময়ে বাবা আর মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম কথা বলতে। দূর থেকে স্কুলের সোশ্যাল-এ দেখেছি মঞ্চে বসে থাকতে। আর দেখেছি দুরু দুরু বুকে, যখন অ্যানুয়ালের রেজাল্ট জানাতে ক্লাসে আসতেন। তদ্দিনে দেওয়ালের ছবি বদলে গেছে। ইন্দিরা গান্ধীর ছবি থেকে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের ছবি, কাস্তে-হাতুরি-তারার ছবি। আমরা ক্লাস থ্রি। সরকার বদল হলো। তার কিছুদিন পরে ঘেঁষের মাঠে স্কুলের আরেকটা বিল্ডিং উঠতে আরম্ভ করলো।
হঠাৎ বড় হয়ে গেলাম। ডে সেকশনে উঠে এলাম। এতদিন ইংরেজি পড়াতেন আরতিদি, শ্যামলীদি। এখন ইংলিশ ক্লাস নেবেন এস.এন.এম., এস.এস. স্যার। কলেজেও এরকমই বলে না? নতুন লাল রঙের ইয়ারবুক চালু হয়েছে। তাতে হোমটাস্ক লিখে রাখতে হবে। নতুন হেডমাস্টার হয়ে এসেছেন ছোটখাটো চেহারার ষষ্ঠীপদবাবু। কিন্তু জনার্দনবাবুর অবর্তমানে স্কুলের কি রকম যেন ছন্নছাড়া অবস্থা।
বাঙুরে অনেক নামকরা মানুষ থাকেন। বনফুল। ভাগলপুর ছেড়ে বাঙুরে ছেলের কাছে থাকেন। থাকতেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ওঁনার নাম জানি। সবে 'আনন্দমেলা' বেরোতে শুরু করেছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী 'আনন্দমেলা'-র সম্পাদক। আর বাঙুর স্কুলের অ্যানুয়াল সোশ্যাল-এ প্রধান অতিথির আসনটি বছর বছর তাঁর জন্যে বরাদ্দ। থাকতেন পূর্ণেন্দু পত্রী। তখন নাম জানতাম না, কিন্তু বিষ্ণু বসু-ও বাঙুরের বাসিন্দা। বিষ্ণুবাবুর ছেলে ব্রাত্যব্রত বসু আমাদের ক্লাসেই পড়ে। আমাদের বন্ধু। ক্লাস সিক্সে ওঠার পরে দেখতাম বাংলার শিক্ষক বাণীব্রত চক্রবর্তী ব্রাত্যর কাছে ওর বাবার কুশল জানতে চান। সিক্সে ওঠার পরে বাঙুর স্কুলের ডে-তে এলাম। প্রায় প্রতিদিনই ইন্দ্রজিতদা এসে ঘোষণা করে ফোর্থ পিরিয়ডের পরে স্কুল ছুটি। আমরা ব্রাত্যর বাড়ি গিয়ে ওর ফুটবল নিয়ে একটা পাইপের-পর-পাইপ রাখা মাঠে ঠাঠা রোদ্দুরে বা ঝমঝমে বৃষ্টিতে গিয়ে বল পেটাই। একদিন বিষ্ণুবাবু দুপুরে বাড়িতে ছিলেন। তলব পড়ল। জবাবদিহি করতে হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু এমনি দু'চার কথা বলে ছেড়ে দিলেন। একদিন 'আনন্দবাজার'-এর 'রবিবাসরীয়'-তে বাণীব্রতবাবুর গল্প বেরোলো। আমরা দারুন খুশি। একজন পাবলিশড লেখককে চিনি বলে কথা!
খেলার পরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরি দল বেঁধে। কেউ বাঙুরেই থাকে। কেউ লেকটাউনে। কেউ বা যাবে পাতিপুকুরে। রাস্তায় পাতলা চ্যাপ্টা পাথর খুঁজি। লেকের জলে ব্যাঙবাজির কম্পিটিশন হবে।
এখন নিজের দিকে তাকালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন মনে পড়ে - "আসলে কেউ বড়ো হয় না, বড়োর মতো দেখায়"। মার্কারি ভেপারের রাতকে-দিন-করে-দেওয়া আলোয় উজ্জ্বল ভিআইপি রোড ধরে যেতে যেতে রাতের বেলা যখন নানা রঙের আলোয় মায়াবি বাঙুর অঞ্চল পেরোই, তখন ভাবতে অবাক লাগে, এই সেই খাটাল-অধ্যুষিত-বাঙুর। আমার বাঙুরে এখনও সন্ধ্যে সাতটাতেই ব্যক্তিগত সন্ধ্যে নামে।
প্রকাশকালঃ ডিসেম্বর, ২০২১